বুধবার, ২৭ সেপ্টেম্বর, ২০১৭

।। জেলখানার জিন্দেগী ।।

প্রায় সকল মানুষেরই জেলখানা লইয়া কম বেশি ভয় আছে। আমার ভেতরও ছিলো । কিন্তু আমার এখন সেই ভয়টা নাই । কারণ আমি জেলখানার ভয়রে কমপ্লিট জয় কইরা আসছি । জেলখানা কিন্তু বেশ মানবিক । অবশ্য অমানবিক কিছু কিছু ব্যাপার আছে । তবে তা খুবই কম ।

জেলখানার প্রক্রিয়াটা হলো , কেউ যখন গ্রেফতার হয় তখন তাকে থানায় নিয়ে যাওয়া হয় । এই গ্রেফতার প্রক্রিয়াটা দুই ধরনের হইতে পারে । এক, মামলা আছে এই কারনে গ্রেফতার । দুই , আগে গ্রেফতার পরে মামলা ।
থানায় ২৪ ঘন্টা রাখার পর আসামিকে কোর্টে পাঠিয়ে দেওয়া হয় । কোর্ট অপরাধ বিবেচনা করে জামিন দিলে দিলো নইলে জেলখানায় পাঠিয়ে দেয় । থানায় যে ২৪ ঘন্টা রাখে সেই সময় গুলোতে পুলিশের কিছু জিজ্ঞাসাবাদ করার দরকার হইলে তখন করে নেয় ।

থানায় থাকাকালীন যদি দেনদরবার ( টাকা পয়সা অথবা হ্যালো) করে বাইরে চলে আসা যায় তাইলে সবচাইতে ভালো । আর না হইলে জেলেখানা ।

জেলখানায় ঢুকার লগে লগে সকল আসামিকে ফাইল করে ফেলা হয় । ফাইল মানে হইলো, এক লাইনে চারজন করে বসাইয়া ফেলা । বসারও একটা নিয়ম আছে । পায়খানা করতে যেইভাবে বসে ঠিক সেইভাবে । তারপর গুইনা নেওয়া হয় টোটাল কয়জন আসামি । তারপর একজন লোক জিজ্ঞাস করে , কারো কাছে টাকা পয়সা আছে কি না । থাকলে তা যেনো "পিসি কার্ডে" জমা দিয়ে দেয় । এই টাকা পরে আসামিরা জেলখানায় খরচ করতে পারে ।
এই প্রক্রিয়া শেষে , সকল আসামির কাপড় চোপড় যা আছে তা চেক করে । কোন অবৈধ জিনিষ পাত্তি আছে কি না ।
চেক প্রক্রিয়া শেষে সকল আসামিকে দ্বিতীয় গেইট দিয়া জেলখানার ভিতরে ঢুকাই "কেইস টেবিলে" নিয়ে আসে । এইখানে আসামিদের একজন একজন করে ছবি তোলা হয় । এবং একজন লোক সকল আসামির কাপড় চোপড় চেক করে । এই চেকে যদি কারো কাছে কোন টাকা ক্যাশ পায় তাহলে তা নিয়ে ফেলে ।
"কেইস টেবিল"- এর কাজ শেষে সকল আসামিকে "আমদামী" করা হয় । "আমদামী" মানে হইলো এই আসামিগুলো নয়া আইছে । আমদামী ঘরটা বেশ বড় । এইখানে সকল নয়া আসামিকে একরাইত থাকতে হয় । এইখানেই অসহায় লাগে বেশি । জেলখানার প্রথম খাবার খায় আসামিরা এইখানে । খুবই জগন্য টাইপ লাগে খাইতে । ঘুমাইতে হয় এক হাত সমান জায়গায় ।

সকাল পাঁচটায় ঘুম থেকে তোলে দেওয়া হয় । তারপর "ফাইল" করা হয় । এক লাইনে চারজন করে বসানো হয় । গুইনা দেখা হয় রাইতের বেলায় যেকজন আসামি আইছে সকালেও ঠিক সে কয়জন আছে কিনা । তারপর গরম ভাত দেওয়া হয় । ভাত খাওয়ার পর আসামিদেরকে জেলখানার নিয়ম কানুন সম্পর্কে হালকা ব্রিফিং দেওয়া হয় । ব্রিফিং শেষে মেডিকেল টিম এসে সকল আসামির স্বাস্থ্য পরিক্ষা করে । দেখে শরীরে সনাক্ত করণ চিহ্ন । যেমন তিল , কাঁটা দাগ এইসব ।

এই প্রক্রিয়া শেষে জেলার আসে । জেলার মানে জেলখানার সবচাইতে বড় কর্মকর্তা । সে এসে কার মামলার হাজিরা কবে তা আসামিদের জানিয়ে দেয় ।

এরপর চলে , আসামি বেচা কেনা । "আমদামি" থেকে আসামিদের বেঁচে দেওয়া হয় ওয়ার্ডে । এই বেঁচে দেওয়া প্রক্রিয়াকে বলে "সিসি মারা" । ওয়ার্ডের "মেট"রা গিয়ে আসামিদের জিজ্ঞাস করে মামলা কি । মামলার ধরন দেখে দাম নির্ধারন হয় । যে মামলার জামিন সহজে হয় না সেই মামলার আসামিদের বেশি দাম দিয়ে কিনে নিতে হয় ওয়ার্ডের "মেট"দের । মেট মানে হইলো , যে লোকের নামে ওয়ার্ডটি বরাদ্ধ । মানে ওয়ার্ডের সর্বসর্বা । যার কথায় ওয়ার্ড চলে । মেট কম টাকায় আসামি কিনবে আমদামি থেকে আর আসামি থেকে বেশি টাকা নিবে ওয়ার্ডে নিয়ে গিয়ে । যদি কোন আসামি টাকা দিতে না পারে তাহলে তার উপর শুরু হয় নির্যাতন । যেমন মেটের হাত পা টিপতে দিবে । বাথরুম পরিস্কার করতে দিবে । নিচ থেকে পানি টানতে দিবে । ওয়ার্ড ঝাড়ু দেওয়াবে । আর যে আসামি মেটকে টাকা দিতে পারবে তাকে দেওয়া হবে সিট । সিট মানে হইলো, আপনাকে একটা নির্দিষ্ট জায়গা দেওয়া হবে । যে জায়গায় আপনি কম্বল বিছিয়ে যতোদিন জামিন হইবে না ততোদিন থাকবেন ।

এই আসামী বেচা কেনা প্রক্রিয়াটা অবৈধ । কিন্তু জেলখানায় এইটা অলিখিত বৈধ হইয়া গেছে । যদি কোন আসামির সুপারিশ থাকে তাহলে তাকে কেউ বেচতে পারে না । সে ওয়ার্ডে গিয়া একটা সিট নিয়া আরামেই থাকবে । আর সরকারি খাওন খাবে । যার সুপারিশ নাই তাকে কেনা বেচা প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে ওয়ার্ডে যাইতে হবে ।
ওয়ার্ডে দুইভাবে খাওনের ব্যবস্থা আছে । এক , সরকারি ভাবে যা দে তা । দুই, মেটের সাথে চুক্তি করে আলাদা টাকা দিয়ে নিজেরা পাক করে খাওয়া । সরকারি ভাবে খাইলে টাকা পয়সা দিতে হয় না । আর মেটের সাথে চুক্তি করে খাইলে দৈনিক দুইবেলা ভাত একশো টাকা । দুপুরে আর রাইতে । রাইতে যদি ভাত বেঁচে যায় তাহলে তা সকালে পানি ভাত হিসাবে খাইতে পারবেন । তবে তরকারি নিতে পারবেন না । তরকারি পাইবেন দুপুরে আর রাইতে । সকালে তরকারি পাইবেন না । সকালে ভাত খাইতে হইলে আপনাকে আলাদা ভাবে ডাল অথবা তরকারি কিনে খাইতে হবে । এইটা চুক্তির বাইরে ।
আপনি যদি পানি না তুলেন নিচ থেকে তাহলে আপনাকে প্রতি সাপ্তাহে একশো টাকা করে দিতে হবে । নইলে আপনার হাগা মুতার পানি আপনাকেই তুলতে হবে । যদি ওয়ার্ডে গোসল করেন তাইলে আপনাকে সাপ্তাহে একশো বিশ টাকা দিতে হবে । নইলে নিচে হাউসে গিয়া লাইন ধইরা গোসল করতে হবে ।

জেলখানায় যদি কোন আসামি অসুস্থ হইয়া পড়ে তাহলে তারজন্য হাসপাতাল আছে । ফ্রি চিকিৎসা এবং ফ্রি ঔষুধ ।
জেলখানায় যদি কেউ আপনার বিরুদ্ধে অন্যায় করে তাহলে আপনি "কেইস টেবিল" এসে বিচার দিতে পারবেন । এবং এই বিচার খুব দ্রুত করে দেওয়া হইবে । অবশ্য জেলখানায় সহজে কেউ "কেইস টেবিল" এসে বিচার দিতে চায় না । ওয়ার্ডের মেট দিয়ে সমাধাণ করাই ফেলতে চায় । "কেইস টেবিল" বিচার বড়ই কড়া । অপরাধ প্রমাণিত হইলে মাইর কারে কয় তা বুঝাইয়া দিবে । মাইরের পর আছে "পানিশমেন্ট ওয়ার্ড" নইলে "সেল" । "পানিশমেন্ট ওয়ার্ড" মানে হইলো, যেসব আসামি বড় বড় ক্রিমিনালি কাজ করে জেলের ভেতর তাদের যেখানে রাখা হয় । যেমন ধর্ষন , চুরি , বাটপারি টাইপ অপরাধ যারা করে । এইখান থেকে কোন আসামি বাইর হইতে পারে না । সারাদিন ওয়ার্ডেই থাকতে হয় । আর সেল মানে হইলো , জেলের ভেতর আরেক জেল । বড়ই কষ্ট সেল ।

জেলখানায় যদি কোন আসামি মাসিক ৩ থেকে ৫ হাজার টাকা খরচ করতে পারে তাইলে জেলখানা তার জন্য কিছুই না । থাকবে খাইবে ঘুমাবে । আর তার সাথে যদি কারো সুপারিশ থাকে তাইলেতো কথায় নাই । জেলখানা তার জন্য আরামখানা ।

আর যে আসামির টাকাও নাই সুপারিশও নাই সেই আসামির জেলখানার জিন্দেগী বড়ই কঠিন । বড়ই নির্মম ।

ভাগ্য ভালো আমার টাকাও ছিলো সুপারিশও ছিলো । তাই জেলখানায় আমি খারাপ ছিলাম না । আরামেই ছিলাম । খাইছি , বই পড়ছি , সিনেমা দেখছি আর ঘুমাইছি ।

মঙ্গলবার, ২৬ সেপ্টেম্বর, ২০১৭

।। জেলখানার জিন্দেগী ।।

জেলখানায় নয়া কেউ গেলে তারে পুরানরা জিগাই , মামলা কি ? আমারেও জিগাইছিলো । আমি কইতাম , আইসিটি এক্ট । বেশির ভাগই বুঝতো না । বেশির ভাগই পাল্টা জিগাইতো , ইবা আবার কি মামলা ? আমি কইতাম , ৫৭ ধারা । আবার জিগাইতো , ইবা কি ধারা ? আমি কইতাম , তথ্য যোগাযোগ ও প্রযুক্তি আইন । তারপরেও বেশির ভাগ লোক বুঝতো না আমার অপরাধ কি । বলতো, তুমি করছোটা কি ?

আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ, আমি একজন রাজাকার যুদ্ধাপরাধী , রাজাকার যুদ্ধাপরাধীর মেয়ে ছাত্রীসংস্থার সাবেক নেত্রী এবং জামাত থেকে আসা আওয়ামীলীগের এমপির বিরুদ্ধে লিখেছি । তখন বলতো , অহ বুঝছি । তুমি হইলা গিয়া "কলম মার্ডার" । আমি প্রথমে বুঝি নাই । "কলম মার্ডার" কি ? জেলখানায় বেশির ভাগ মামলারই কিছু উপনাম আছে । যেমন আমি গ্রেফতার হইছি , তথ্য যোগাযোগ ও প্রযুক্তি আইনে আর আমার মামলার উপনাম "কলম মার্ডার" । মানে আমি লেখা দিয়া মার্ডার করছি । কলম দিয়াই যেহেতু লেখা তাই তারা নাম দিয়েছে এই "কলম মার্ডার" ।

আমি একদিন , ওয়ার্ড থেকে বাইর হইয়া , সিগারেট ফুকতাছি । যেখানে সিগারেট ফুকতাছি তার পাঁশে "কোরান দফা" । মানে এই ঘরে কোরান তেলোয়াত করা হয় । সকাল আটটা থেকে দুপুর বারোটা পর্যন্ত ।

কোরান দফা থেকে একজন ছেলে বের হইয়া (প্রায় আমার সমবয়সী) একটা পান নিলো বেশি কইরা জর্দা দিয়া । ছেলেটির পরনে সাদা জুব্বা , মুখে দাড়ি । তারপর আমার পাঁশে আইয়া জিগাইলো, ভাই কি মামলা ? আমি কইলাম, আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ, আমি একজন রাজাকার যুদ্ধাপরাধী ও রাজাকার যুদ্ধাপরাধীর মেয়ে ছাত্রীসংস্থার সাবেক নেত্রী এবং জামাত থেকে আসা আওয়ামীলীগের এমপির বিরুদ্ধে লিখেছি ।

ছেলেটি বললো , আওয়ামীলীগ হইলো কুত্তার দল । এরা ইহুদি নসরা । এরা আলেম ওলেমাদার সম্মান দেয় না । আওয়ামীলীগ আলেম ওলেমা বিরোধি । আওয়ামীলীগ ইসলাম বিরোধি । কোন ঈমানন্দার মুসলমান আওয়ামীলীগ করতে পারে না । আওয়ামীলীগ করলেই জাহান্নাম নিশ্চিত । দেলোওয়ার হোসাইন সাইদির মতো একজন আলেমরে যুদ্ধাপরাধী কইয়া জেলে আটকায় রাখছে । কত্ত বড় জালিম এই আওয়ামীলীগ ! আল্লাহর গজব পড়বে এই হাসিনার উপর ! এই নাস্তিক সরকারের পতন একদিন হবেই হবে ! এই জালিম সরকারের পতন একদিন হবেই হবে ।- ইনশাআল্লাহ ।

ছেলেটি আমারে উপদেশের সহিত কইলো, ভাই জামাতের বিরোধিতা করেন সমস্যা নাই কিন্তু আলেমওলেমাদের বিরোধিতা কইরেন না । আল্লাহর গজব পড়বে । রাজাকার যুদ্ধাপরাধী কি আওয়ামীলীগে নাই ? তাদের বিরুদ্ধে লেখেন । আলেমওলেমাদের রাজাকার যুদ্ধাপরাধী কইলে আল্লাহর গজব পড়বে ।

আমি তারে জিগাইলাম ভাই আপনার কি মামলা , ছেলেটি কয় সে চাঁদগাও একটা মাদ্রাসায় হাফেজি পড়াইতো (মানে কোরান পড়াইতো) আর নামাজ কালাম শিখাইতো । ইসলামের দাওয়াত দিতো । কিন্তু স্থানীয় আওয়ামীলীগের লোকেরা এইটা সহ্য করতে পারতো না । তাই তারা ক্ষমতার জোর খাটাইয়া তার মতো একজন আলেমকে জেলে ঢুকাই দিছে । যেনো কোরানের আলো ছড়াইয়া না পরে ।

ছেলেটির মুখে এই কথা শুইনা আমি পুরাই তবদা খাইগেলাম । মনে মনে নিজের লজ্জা হইতে লাগলো । একজন লোক কোরান শিখায় নামাজ কালাম শিখায় আর তারেই আওয়ামীলীগ জেলে ঢুকাই দিলো ! আমিতো জানি আওয়ামীলীগ ইসলাম বিরোধি নয় । কিন্তু এখনতো যা শুনছি তাতে মনে হচ্ছে , আওয়ামীলীগ ইসলাম বিরোধি । ছেলেটির কথা শুইনা আমার নিজের উপর নিজেরই ঘৃণা হইতে লাগলো । কারণ আমি একজন আওয়ামীলীগ সমর্থক । আমি ধর্মনিরপেক্ষ অসাম্প্রদায়িক চেতনা এবং জাতির পিতার আদর্শ মনে প্রাণে ধারন করি । লজ্জায় অপমানে আমার বলতে ইচ্ছা করছিলো , হে মাটি তুমি ফাঁক হয়ে যাও আমি ঢুকে যাই ! ছেলেটিকে আর কিছু না বলে , আমি চলে আসলাম আমার ওয়ার্ডে ।

ওয়ার্ডে আইসা বই নিয়া বসলাম । আমার পাশে একজন ছেলে এসে বলল, যে ছেলের সাথে কথা বলছো তুমি তারে চিনো ? আমি বললাম না । আইজই কথা হইলো । ছেলেটি বললো , ও আগে আমাদের এই ওয়ার্ডে থাকতো । এইখানে নামাজ পড়াইতো । এখন এই বিল্ডিংয়ের চারতলায় থাকে ১২ নং ওয়ার্ডে । সেখানে ইমামতি করে । আমি বললাম , ওহ । ছেলেটি বললো , তার মামলা কি জানো ? আমি বললাম , সে কইছে কোরান হাদিস শিখায় বলে তারে আওয়ামীলীগের লোকেরা ক্ষমতার অপব্যবহার কইরা জেলে ঢুকাই দিছে ।

ছেলেটি হাইসা দিয়া কয় , মাদারিচুদ আলা পোদাপোয়া । সেরা ভন্ড । আমি কইলাম কি কন! ছেলেটি কয় , সে চাঁদগাও'তে একটা মাদ্রাসায় হাফেজি পড়াইতো । হাফেজি পড়ানোর সময় একটা ছয় বছরের ছেলেকে তার অফিস রুমে ডেকে নিয়ে যায় । তারপর ছেলেটিকে বলৎকার করার সময় ছেলেটি চিৎকার দিলে বাকি ছাত্ররা দৌড়ে ভেতরে গিয়ে দেখে ছেলেটি কাপড় চোপড়হীন অজ্ঞান হয়ে পড়ে রইছে । হৈচৈ শুরু হলে আশেপাশের লোকজন চলে আসে । তারপর শুরু হয় ব্যাপক মাইর । মাইরের পর তাকে পুলিশের কাছে তুলে দেওয়া হয় । থানায় নিয়ে গেলে ছেলের বাবা বাদী হয়ে নারী ও শিশু নির্যাতনে তার বিরুদ্ধে একটা মামলা করে । সেই মামলায় হুজুর এখন প্রায় ১১ মাস জেলখাটছে । শালা "পাছা মার্ডার" । ভন্ডের ভন্ড ।

তারপর আমি বুঝতে পারলাম , একজন অপরাধী তার অপরাধ ঢাকতে ধর্মকে ঢাল হিসাবে কিভাবে ব্যবহার করে । কিভাবে আওয়ামীলীগের বিরুদ্ধে ধর্ম এবং ধর্মীয় অনুভিতিকে অস্ত্র হিসাবে ব্যবহার করে ।

ছেলেটির নাম জিয়াউর রহমান । বাবার নাম খুব সম্ভবত মাহবুব । বাড়ি পুকুরিয়া (চানপুর) , বাঁশখালী । মাদ্রাসা থেকে পড়াশুনা করে দীর্ঘদিন দেশের বাইরে ছিলো । হেফাজত ইসলামের সে একজন একটিভ কর্মী । আর এখন সে কর্ণফুলি বিল্ডিংয়ের চার তলায় ১২ নং ওয়ার্ডে ইমামতি করে । আর চব্বিশঘন্টা আওয়ামীলীগ এবং সরকারকে ইসলাম বিরোধি নাস্তিক কইয়া লোকোজনরে বুঝায় ।

আইচ্ছা এমন হুজুর কি বাঙালি জাতি কখনোই চাইছিলো ?

।। জেলখানার জিন্দেগী ।।

জেলখানায় যাওয়ার পর আমি ব্যাভাছ্যাকা খাইয়া বইয়া রইছি ওয়ার্ডে। বইয়া বইয়া আমার অসুস্থ মা আর ছোট তিন বোনের কথা ভাবতেছিলাম। এমন সময় আছরের নামাজের আজান দেয় গুটি ( ইয়াবা) মামলার আসামি করিম হুজুর। আযান শুইনা ওয়ার্ডের লোকজন যারা নামাজ পড়ে তারা বাথরুমের দিকে যাচ্ছে অযু করার জন্য। আর যারা নামাজ পড়ে না তারা হয় ওয়ার্ডে চুপচাপ বইয়া থাকে নইলে নিচে বারান্দায় আইসা বইয়া থাকে। নইলে সিগারেট বিড়ি ফুঁকে ফুঁকে আড্ডামারে।
আমি নিচের দিকে নামতে যাচ্ছিলাম। এমন সময় মোঃ শামসুল আলম আমাকে বলল, চৌধুরী সাব নামাজ পড়বেন না? আমি কইলাম, না আমি নামাজ পড়বো না। শামসুল আলম আবার জিগাইলো, ক্যা? আমি কইলাম, ভাই আমার মন নামাজ পড়তে চাচ্ছে না এখন। মন চাইলে নামাজ পড়তাম। শামসুল আলম কইলো, মনের বিরুদ্ধে জিহাদ করেন। আমি কইলাম, ভাই আমি মনের বিরুদ্ধে জিহাদ প্রত্যেকদিনই করি বাট জিহাদে মন জিতে যায় বারবার আর আমি হেরে যায়। এইবার শামসুল আলম আমার হাতটা ধইরা কয়, ভাইরে জেলখানায় আছি আমরা। আল্লাহ ছাড়াতো আর কেহ নাই। আল্লাহ'রে না ডাকিলে জামিন হইবে কেমনে? আমি কইলাম, ভাই জামিন হইবে কেমনে- এইডা জানি না তবে একটা কথা জানি আল্লাহ আমারে খুবই ভালোবাসেন। তাই আপনি নিশ্চিত থাকতে পারেন আমার জামিন হইয়া যাইবে। আমি উইঠা নিচের দিকে হাঁটা দিলাম।
দেখি আমার লগে লগে শামসুল আলমও আসতাছে। আমি কইলাম, ভাই আপনি নামাজ পইড়া আসেন। আমি নিচে আছি। শামসুল আলম কয়, ভাই আপনারে আইজ একটা কথা কইবো। আমি কইলাম নামাজ পইড়া বইলেন। শামসুল আলম কয়, নামাজ পরে পড়বো। আগে কথা শুনেন। আমি কইলাম, চলেন।
বারান্দায় আমি আর শামসুল আলম। সিগারেট ফুঁকতাছি। শামসুল আলম কয়, ভাই বিশ্বাস করবেন কি না জানিনা। আমি মাত্র দেড় হাজার টাকা দিয়া গুটি ব্যবসা শুরু করেছিলাম। আইজ আমার কক্সবাজারে বাড়ি আছে, টেকনাফে বাড়ি আছে। বউ আছে দুইটা। একটা কক্সবাজার আরেকটা আমার পুরান বাড়ি টেকনাফে থাকে। আমার মেয়েরে আমি কক্সবাজার থেকে বিমানে করে ঢাকায় আনি ঈদের শপিং কইরা দিতে। আমি কিন্তু ইংরেজি পড়তে জানি না। আমার মাইয়া নাইনে পড়ে সে সব পড়তে পারে। আমার মাইয়া'ই টিকেটের ইংরেজি পইড়া আমারে দেখাইয়া দে বিমান কোনটা।
জায়গা কিনছি দুইকানি। ধার দেনা ছিলো প্রায় আড়াই লাখ তাও শোধ করছি। অস্ত্র কিনছি দুইটা। একদিন মা আইসা কয়, তোর এখন এতো টাকা! আল্লাহ যদি আমার হজ্বটা নসিবে রাখতো! মা'রে কইলাম, মা আমারে একটা মাস সময় দাও আমি হজ্বের টাকা জোগাড় করি।
পরের সাপ্তাহে এক লাখ গুটি নিয়া আল্লাহর নামে রাওনা দিলাম টেকনাফ থেকে ঢাকার উদ্দেশ্যে। মনে মনে নিয়ত করলাম এই গুটি বেইচ্ছা যা টাকা পাবো তার সবটুকু আমার মা'র হজ্বের জন্য ব্যয় করবো। আমার সাথে আরো চারজন ছিলো। তারও গুটি ব্যবসায়ী। আমরা পাঁচজন পাঁচ গাড়িতে উঠলাম। কিন্তু কি আল্লাহর রহমত চাইরজনই ধরা খাইছে। কিন্তু আমি ধরা খাইনাই। অথচ আমার গোটা গাড়ির সবাইকে চেক করলো আমারে চেক করে নাই। আমারে চেক করতে গেছিলো এমন সময় পেছন থেকে একটা ট্রাক এসে ধাক্কা মারে গাড়িতে। এবং এইডা লইয়া ট্রাক ড্রাইভার আর বাস ড্রাইভারের লগে লাইগলো ক্যাচাল আর ক্যাচাল থামাইতে পুলিশ ব্যস্ত হইয়া নাইমা গেলো। আর আমি পার পাইয়া গেলাম।
আল্লাহ'রে না ডাকলে কোনদিন কামিয়াব হওয়া যাবে না। আপনি চুরি করেন ডাকাতি করেন গুটি বেঁচেন সমস্যা নাই কিন্তু নামাজ না পড়লে সমস্যা আছে। নামাজই হইলো সব। যার নামাজ নাই তার জন্য বেহেস্তও নাই। বুঝলেন ভাই? আমি কইলাম, বাঙলায়তো কইলেন না বুইঝা উপায় আছে!
আইচ্ছা ভাই, আপনার মা'কে হজ্ব করাইছিলেন?
শামসুল আলম কয়, হ্যাঁ আমার মা'কে হজ্ব করাইছি।
শামসুল আলম দুই হাজার গুটি লই ধরা খাইছে আকবর শাহ থানায়। এখন সে কর্ণফুলী চার নং ওয়ার্ডে প্রায় এগারো মাস ধরে হাজত কাটছে।

।। জেলখানার জিন্দেগী ।।

।। জেলখানার জিন্দেগী ।।

জেলখানায় একটা "কোরান দফা" আছে । এইখানে কোরান পড়ে হাজতিরা । তার পাশে একটা দোকানে পান সিগারেট বেঁচে । আমি এক খিলি পান আর একটা ডারবি সিগারেট দোকান থেকে নিয়া খুব আরামচে সময় নষ্ট করছিলাম ।

কোরান দফা থেকে একজন হুজুর বের হইয়া এক খিলি পান নিয়া আমার পাশে দাঁড়াইয়া পান চিবাইতেছিলো । আমি অবাক হইয়া ভাবতে ছিলাম , একজন হুজুর জেলখানায় থাকবে কেন?

হুজুররে জিগাইলাম , হুজুর মামলা কি ? হুজুর কইলো , গুটি (ইয়াবা) । বুঝলাম গুটি নিয়া ধরা খাইছে । হুজুররে পাল্টা জিগাইলাম , হুজুর ধরা খাইছেন ক্যামনে ? হুজুর কয় , টেকনাফ থেকে একটা হানিফ বাস রিজার্ভ কইরা সাতান্নজন তবলিগে যাইতেছিলো । গাড়ি মইজ্জার টেক আইলে পুলিশ তাদের গাড়ি থামাইয়া তল্লাশি করতে চায় । গাড়ির ভেতরের সকল হুজুররা বলে , তারা আল্লাহর রাস্তায় যাইতেছে তাদের কাছে কোন অবৈধ কিচ্ছু নাই । তাদের ব্যাগে যা আছে তা কোরান হাদিস আর কিছু জামা কাপড় । পুলিশ কয় , তাদের কাছে স্ট্রং ইনফরমেশন আছে এই গাড়িতে করে বিপুল সংখ্যক ইয়াবা ঢাকায় পাচার হচ্ছে ।

বাকবিতণ্ডার এক পর্যায়ে পুলিশ হুজুরদের বলে , যাদের ব্যাগে কোরান হাদিস আছে তারা যেনো কোরান হাদিস হাতে নিয়া নে । আর বাকি জামা কাপড় যেনো নিচে বিছানো চাদরে ডাইলা দে । পুলিশ প্রত্যেকের জামা কাপড় এবং ব্যাগ চেক করবে ।

এতে বেশির ভাগ হুজুর রাজি হয় । এবং তারা তাদের জামা কাপড় চাদরে ডাইলা দে । পুলিশ একেক করে সব জামা কাপড় এবং ব্যাগ তল্লাশি করে । এবং সাতজনের কাছে প্রায় ৫ লাখের মতো ইয়াবা পায় । এবং যাদের কাছে ইয়াবা পায় তারা সকলেই টেকনাফের একটা স্থানীয় মাদ্রাসার কোরানে হাফেজ । পুলিশ সাতজনকে গ্রেফতার কইরা জেলখানায় পাঠাইয়া দে । আর বাকিদের তবলিগে যাওয়ার জন্যে গাড়ি ছাইড়া দে ।

আমি হুজুরের মুখ থেকে এই কাহিনী শুইনা হুজুররে জিগাইলাম , হুজুর ইয়াবা ব্যবসাতো হারাম । আপনি একজন কোরানে হাফেজ হইয়া এই ব্যবসা করতাছেন কিয়ামতের দিন আপনি আল্লাহকে কি জবাব দিবেন ? হুজুর কয় , আমি হালাল টাকায় ব্যবসা করছি । আমিতো আর ইয়াবা খাচ্ছি না । আর ইয়াবাতো একটা মেডিসিন । আমিতো ওষুধ হিসাবে বিক্রি করতেছি । মাদক হিসাবে না ।

হুজুর আমিতো জানি ইয়াবা একটি মাদক । হুজুর কয়, আমি মাদকের নিয়তে বিক্রি করতেছি না আমি ওষুধের নিয়তে ব্যবসা করছি । আর কোরানের কোথাও ইয়াবা সম্পর্কে বলা হয় নাই । কোরানে বলা হয়েছে মদ আর গাঁজা সম্পর্কে । আমিতো আর মদ গাঁজা বিক্রি করছি না ।

ইয়াবা যারা মাদকের নিয়তে খাচ্ছে তাদেরই কৈফিয়ত দিতে হবে । যারা ওষুধের নিয়তে ব্যবসা করছে তাদেরকে হাশরের ময়দানে কৈফিয়ত দিতে হবে না ! আল্লাহ ব্যবসাকে হালাল করেছেন আর সুদকে হারাম করেছেন। আমি হালাল টাকায় হালাল নিয়তে ইয়াবা ব্যবসা করছি । আমি সুদ খাচ্ছি না । আমি স্রেফ ইয়াবা ব্যবসা করছি । আমার কৈফিয়ত দেওয়ার প্রশ্নই আসে না !

তারপর হুজুর আমারে জিগাই, ভাই আপনার মামলা কি ? আমি কইলাম , হুজুর তথ্য যোগাযোগ ও প্রযুক্তি আইন । হুজুর কয়, ওহ বুঝছি । আপনি ব্লগার ? আমি কইলাম , হুম । হুজুর কইলো, আপনি নাস্তিক । আপনার লগে কথা কইলেও গুনা । ব্লগাররা জাহান্নামে যাইবে । আপনি ফি নারে জাহান্নাম ।

আমি কইলাম , হুজুর ব্লগাররা জাহান্নামে যাইবে এইডা কি কোরানের কোথাও আছে ? হুজুর কইলো, কোরানে নাই এমন কোন কিছুই দুনিয়াতে নাই ।

হুজুর পান চিবাইতেছে আর আমি সিগারেটের শেষ টানটা মাইরা আমার ওয়ার্ডের দিকে হাঁটা দিলাম ।

হুজুরের নাম, মুহাম্মদ আবদু সত্তার । বাড়ি কলেজ রোড টেকনাফ । থাকে পদ্মা আটারোতে ।

শুক্রবার, ১৫ সেপ্টেম্বর, ২০১৭

।। জেলখানার জিন্দেগী ।।

জেলখানায় একটা লোকের সাথে আমার বেশি সখ্যতা হইছিলো । লোকটার বাড়ি উখিয়া থ্যাইংখালী । লোকটার নাম আবু তাহের । বয়স আনুমানিক ৩৮ বছর । স্থানীয় ওয়ার্ড আওয়ামীলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক । দুই হাজার গুটি (ইয়াবা) লইয়া ধরা খাইছে মইজ্জ্যার টেক । ৬ মাস ধরে জেল খাটছে । মেজিস্ট্রেট কোর্ট জজ কোর্ট জামিন দেয় নাই । তার মামলার ফাইল এখন হাইকোর্টে ।
সখ্যতা বেশি হওয়ার কারণটা বলি । পাকিস্তান ভারতের খেলা চলছে বিটিভিতে । আইসিসি ওয়ার্ল্ড কাপের ফাইনাল খেলা। আমরা সকল ওয়ার্ডবাসী খেলা দেখছি । আমি ভারত সাপোর্টার । আর বাকি সকলেই পাকিস্তান সাপোর্টার । আমি মুসলমান ঘরে জন্ম লইয়া কেনো হিন্দু রাষ্ট্র ভারতকে সাপোর্ট করছি এই জন্যে সকলেই আমাকে টিপ্পনি খাটতে লাগলো । বিপরীতে আমি তাদের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস তুলে ধরছি । কিন্তু তারা তা বুঝতেও চায় না শুনতেও চায় না । তাদের কথা পরিস্কার ফকফকা । বাঙলাদেশের রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম পাকিস্তানের রাষ্ট্র ধর্ম ইসলাম । মুসলমান মুসলমানের পক্ষে থাকবে হিন্দুর পক্ষে নয় । খেলা শেষে যখন পাকিস্তান জিতে গেলো তখন , সবার টিপ্পনী কাটার মাত্রাটাও বেশি হয়ে গেলো ।
পাকিস্তানী সাপোর্টারের কথার গুঁতায় আমি কাহিল হইয়া একটা বই নিয়া পড়তে বসছি । কিছুক্ষন পর আবু তাহের আমার পাশে আইসা ফিসফিসাইয়া কয়, একাত্তরে পাকিস্তানীরা কতো নির্যাতন করছে এই বাঙালিরে অথচ আইজ এই বাঙালিই দেশের ভিতর বুক চাপড়াইয়া পাকিস্তানের পক্ষে কথা কয় । এইসব কথা আমি ওয়ার্ডে কই না । ওয়ার্ডের এরা বেশির ভাগই অশিক্ষিত । আমি যদিওবা পড়ালেখা বেশি করি নাই ! কিন্তু তারপরেও আমি দেশের জন্ম ইতিহাস জানার চেষ্টা করছি । আপনি মন খারাপ কইরেন না । আমিও কিন্তু ভারত সাপোর্টার । আপনার মতো প্রকাশ্যে করি না মনে মনে করি । আজকে যদি ভারত জিততো তাইলে আমি কিন্তু খুশি হইতাম ।
আমি সেদিন তার সাথে আর কোন কথা বলি নাই । পরের দিন সকালে আমি আর আবু তাহের বিল্ডিংয়ের নিচে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কথা বলছি । প্রায় ২০ মিনিট যাবত । এমন সময় একজন লোক এসে বলল, আমাদেরকে মেট- এ ডাকে । (ওয়ার্ডটি যার দায়িত্বে থাকে তাকে মেট বলে । মেট'ই হচ্ছে একটি ওয়ার্ডের সর্বসর্বা) । আমি আর আবু তাহের দুইজনই তড়িঘড়ি করে ওয়ার্ডে চলে আসছি । ওয়ার্ডে এসে দেখি থমথমে অবস্থা । সবাই যার যার সিটে আওয়াজ ছাড়া বইসা আছে । মেট আবু তাহেরকে জিজ্ঞাস করলো , তুই নতুন পোলা (আমার দিকে আঙ্গুল দিয়া ইশারা কইরা) ইতার লগে এতো কথা কি ? আবু তাহের আমতা আমতা কইরা কয় , কিছু না বদ্দা (বড় ভাই) আমরা এমনিতেই কথাবার্তা বলছিলাম । মেট বসা থেকে উইঠা , লাথি ঘুষি কিল চড় থাপ্পড় দিতে দিতে কয় , তুই জানস না জেলখানায় নতুন আসামীর সাথে কথা বলা যায় না ! তোদের ফাইলের সময় আমি বলি নাই ! আবু তাহের বদ্দা বদ্দা... ছাড়া আর কিছুই বলবার সুযোগ পাইতেছেনা । শুধুই মাইর চলতেছে ! আমি বেকুব বইনা গিয়া হাঁটু বুকে লইয়া বইয়া থাকলাম ।
মেট আবু তাহেরকে মাইরা আমার কাছে আইসা কয় , ইতার কোন দেখা নাই সাক্ষাৎ নাই (কেউ দেখতে আসে না ) । সিটের টাকা পাবো এক হাজার টাকা সেইটা দিতে পারতেছেনা । নতুন কেউ আসলে ভাউ দিয়া টাকা পয়সা হাতাইতে চায় । ইতার থেকে দূরে থাকবা । কোন কথা বলবা না । আমি আইচ্ছা কইয়া জুবুথুবু হই বইসা রইলাম !
আবু তাহেরকে কঠোর ভাবে নিষেধ করে দেওয়ার পরেও সে আমার সাথে লুকিয়ে লুকিয়ে কথা বলতো । আওয়ামীলীগ করার কারনে তাকে এলাকার অশিক্ষিত কুশিক্ষিত কুসংস্কারাচ্ছন্ন এবং ধর্মান্ধ উগ্রবাদীরা কিভাবে মানসিক নির্যাতন করতো তা বলতো । আমি তার কথা শুনতাম আর হ্যাঁ হু করতাম । আর আমি বুঝতে পারতাম আমার সাথে তার এই সখ্যতা কেবলই বিড়ি খাওয়ার জন্য । কারণ তার দেখা নাই (সাক্ষাৎ করতে কেউ আসে না ) । জেলখানায় সরকারি ভাবে থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা হলেও সরকারি ভাবেতো আর বিড়ি খাওয়া যায় না ! বিড়ি খাইতে হইলে ক্যাশ টাকা লাগে । আর সেই ক্যাশ টাকা তার নাই ।
আমি সকালের ভাত খেয়ে একটা সিগারেট জ্বালিয়ে ওয়ার্ড থেকে নিচে নেমে বারান্দায় বই পড়তে আসি প্রত্যেকদিন । আবু তাহের সকালের রুটি আর মিঠা নিয়ে বারান্দায় আমার পাশে বসে খায় । উদ্দেশ্য তার খাওয়া শেষ হইলে আমার সিগারেট থেকে ভাগ নিতে পারবে । আর আমিও তারে না দিয়ে খায় না ।
এইভাবে দুই একদিন যাওয়ার পর আমি আবু তাহের সম্পর্কে একটা ধারনায় আসলাম । এই লোকটি নিন্মমধ্যবিত্ত জীবন যাপনের একজন আওয়ামীলীগ সমর্থক । আওয়ামীলীগরে ভালোবাসে । সে চায় মনে প্রাণে মুক্তিযুদ্ধের ধর্মনিরপেক্ষ অসাম্প্রদায়িক চেতনা এবং জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর আদর্শ এই বাঙলাদেশে কায়েম হোক । কিন্তু অভাবের জন্য জেলখানায় বিড়ি খাইতে পারছে না । তাই সে এর ওর কাছে বিড়ি খুইজা খায় । আর এই খুইজা খাইতে খাইতে তার মান ইজ্জত হারাইছে । আমি চিন্তা করলাম এই লোকের যদি বিড়ির অভাব দূর করা যায় তাইলে এরে দিয়া কিছু কাজ করাইতে পারবো ।
আবু তাহেরকে হুমায়ন আহমেদের " শঙ্ঘনীল কারাগার" বইটা দিয়ে কইলাম , আপনি যদি এই বই ৫০ পাতা পড়তে পারেন আজ এবং কালকের ভিতরে তাইলে আপনি ১২ টা বিড়ি পাইবেন । আর যদি পুরা শেষ করতে পারেন তাইলে এক বান্ডি বিড়ি পাইবেন । আবু তাহের কয় ঠিকাছে আগে বিড়ি দেন তারপর পড়বো । আমি কই , আগে পড়েন তারপর বিড়ি । যদি পড়া শেষ করার পর আপনি বিড়ি না দেন তাইলে ? আমি কইলাম , ভাই আমি জবানে এবং ঈমানে ঠিক । আমি যা কইবো তা অবশ্যই পালন করবো । বাঙলাদেশের কসম । তবে আমি কিন্তু আপনার থেকে জিজ্ঞাস করবো যা পড়ছেন তার সম্পর্কে । আবু তাহের রাজি হইলো ।
সে বই পড়ে আর আমি তাকে বিড়ি দিই । একটা বই পড়তে পারলে এক বাড্ডি বিড়ি আর এক কাপ চা ।
প্রথম বই পড়ার পর তার ভেতর একটা অভূতপূর্ব পরিবর্তন লক্ষ্য করলাম । সে বলে , এই বই পড়ে আমার বহুত কিছু পরিবর্তন আসছে মনমানসিকতায় । আপনি আমাকে আরো কয়েকটা বই আইনা দেন । আমি কই, বিড়ি খাওয়ার জন্যে নাকি মন মানসিকতা পরিবর্তন করার জন্য । কয়, দুইটায় ।
এইভাবে "নন্দিত নরকে" "হিমু সমগ্র" "বেকারত্বের দিন গুলিতে প্রেম" "তিথির নীল তোয়ালে" "অথচ আজ বসন্ত" এবং "মা" পড়ার পর তারে কইলাম , তাহের ভাই আপনি যদি , এই দেয়ালে (বারান্দার দেয়াল)
হিন্দু
মুসলমান
বৌদ্ধ
খৃষ্টান
ভুলে যান
পরিচয় এক্কান
"বাঙালি"
- এই কথা লিখতে পারেন তাইলে আমি আপনাকে লেখা শেষ হওয়া মাত্রই এক বান্ডি বিড়ি আর এক কাপ চা খাওয়াবো । আবু তাহের খুশি হইয়া কয় , একটা বই পড়তে দুই তিন দিন লাইগা যায় আর এতো মাত্র ত্রিশ মিনিটের কাম । আমি কইলাম তাইলে লেখা শুরু করেন ।
বারান্দা থেকে বের হয়ে সে একটা লাল ইটের টুকরা নিয়ে এলো । বারান্দার দেয়ালে সাদা চুন দেওয়া । তাই লাল রঙের ইটের ঠুকরা দিয়ে লিখবে । আমি কইলাম , তাহের ভাই আমি আগে লিখে দিই আপনি সেই লেখার উপরে বারবার লিখতে থাকবেন । আমি লিখে দিলাম তারপর সেই লেখার উপর বারবার লিখে আবু তাহের চিকা সম্পন্ন করলো । আর আমিও তার ঘাম না শুকাবার আগেই বিড়ি দিয়ে দিলাম আর লেখা শেষে চা খাওয়াইলাম । জেলখানায় এক বান্ডি আকিজ বিড়ি ত্রিশ টাকা আর এক কাপ চা (আমরা টং দোকানে যে চা খাই তার তিন ভাগের একভাগ চা পাঁচ টাকা)
আবু তাহের আর আমি কর্নফুলি বিল্ডিংয়ের বারান্দায় প্রায় ১৩টা চিকা মারি । এবং এই প্রত্যেকটি চিকার জন্যে আবু তাহেরকে বিড়ি আর চা খাওয়াইছি জবান মতো । চিকাগুলো হইলো...
চিকা-২।
আসুন মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় ফেরত যাই
আমরা জাতির পিতার রক্ত
বাঙলাদেশের ভক্ত ।
চিকা-৩।
দুই লাখ মা বোনের ইজ্জত
ত্রিশ লাখ শহীদের রক্ত
ভুলি নাই ।
দেশ প্রেম না থাকিলে ঈমানদার হওয়া যাইবে না ।
চিকা-৪।
নামাজ পড়বেন
অন্যের বিরুদ্ধে নামাজকে অস্ত্র হিসাবে ব্যবহার করবেন না ।
চিকা-৫।
ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য যারা ধর্মকে ব্যবহার করে তারা ধার্মিক নয় । তারা ভন্ড ।
চিকা-৬।
কোন ধর্মই ছোট নয়
যারা অন্যের ধর্মকে ছোট করে দেখে তারা ধার্মিক নয় । তারা ঝামেলাবাজ ।
চিকা-৭ ।
ধর্মের চাইতে মানুষ বড়
মানুষের চাইতে দেশ বড়
মুক্তিযুদ্ধের চেতনায়
বাঙলাদেশ গড় ।
চিকা-৮।
যারা জাতীয় সংগীত গায় না
যারা জাতীয় পতাকাকে সম্মান দেয় না
তারা দেশপ্রেমিক নয়
তারা দেশদ্রোহী
তাদের ঘৃণা করতে হবে ।
চিকা-৯ ।
অসাম্প্রদায়িক চেতনা
বাঙালি জতির প্রেরণা
চিকা-১০।
পাকিস্তানপ্রেমীরা দেশপ্রেমিক নয়
১৯৭১ ভুলি নাই ।
চিকা-১১।
জয় বাঙলা কোন দলীয় স্লোগান নয়
জয় বাঙলা মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সকল বাঙালির প্রাণের স্লোগান ।
চিকা-১২ ।
সবার আগে "দেশ"
তারপর "মানুষ"
তারপর "ধর্ম"
হে মানব সমাজ
চিন্তা করে দেখলে
বুঝিবে এই কথার মর্ম ।
চিকা-১৩।
যারা নিজেদের অপরাধ ঢাকতে ধর্মকে ঢাল হিসাবে ব্যবহার করে
তারা ধার্মিক নয়
তারা ভন্ড ।
পাঁচতলা বিল্ডিংয়ে প্রায় ৮০০ জন লোক থাকে । তাদের মধ্যে গড়ে প্রায় ৫০০জন লোক দিনের বিভিন্ন সময়ে বারান্দায় হাঁটতে আসে । তারা কেউ এই চিকাগুলো পড়ে চিন্তা করে আবার কেউ এই চিকা পড়ে গালাগালি করে আবার কেউ এই চিকা পড়ে ভালাও কয় না খারাপও কয় না ! তবে এই চিকাগুলোর কারনে ওয়ার্ডে একটা প্রভাব পড়ছে । ওয়ার্ডের যেসব লোক মুক্তিযুদ্ধ , জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং আওয়মীলীগ নিয়া কুটুক্তি করতো প্রকাশ্যে তারা আর প্রকাশ্যে করে না । এবং কিছুটা চুপ গেলো ।
জেলখানার দেওয়ালে লেখালেখি করা অন্যায় । কে লিখছে কইতে পারলে ব্যাপক ঝামেলা পোহাইতে হইবে । তার উপর মাইরতো আছেই । তবে জেলখানায় সচরাচর কেউ বিচার দেয় না কেউ সাক্ষীও দেয় না । কারণ বিচারের সাক্ষী যে হইবে তাকেও পাছার উপর দুই ডান্ডাবারি নিতে হইবে ।- আমি এমনটি শুনেছি তবে দেখিনি । যে সাক্ষী দিবে তাকে কেনো মারবে ?
কিন্তু প্রত্যেকটি বিল্ডিংয়ের দেয়ালে প্রেমিক প্রেমিকার নাম , মোবাইল নাম্বার , জেলখানায় আগমনের তারিখসহ বিভিন্ন কিছু লিখে রাখছে বিভিন্ন লোকজন । আমি এইসব লেখাগুলো দেখে চিন্তা করলাম তাদের লেখাগুলোর চাইতে আমার চিকা গুলো বহুত মূল্যবান ।
আবু তাহের বারান্দায় এসে চিকা গুলোর দেখাশুনা করতো । কেউ মুচে দিচ্ছে কিনা অথবা কেউ দেয়ালে হেলান দিলে অজন্তে মুচে যায় কিনা ! যদি মুচে যায় তাহলে সে আবার লিখে দিতো । একদিন একটি চিকা মুচে দিয়েছিলো একজন হুজুর । তার বাড়ি টেকনাফ । নারী ও শিশু নির্যাতন মামলায় ৪ বছর ধরে জেল খাটছে । কর্ণফুলি তিন নং ওয়ার্ডে । ঘরে বউ থাকার পরেও মক্তবে পড়তে আসা ৭ বছরের একটি মেয়েকে ধর্ষণ করতে গিয়ে ধরা পড়েছে ।
সে মুচে দিয়েছিলো "কোন ধর্মই ছোট নয় যারা অন্যের ধর্মকে ছোট করে দেখে তারা ধার্মিক নয় । তারা ঝামেলাবাজ ।"- এই চিকাটি।
কিন্তু আবু তাহের সেটি আবার বড় করে লিখে দিয়েছে । আর আমার কাছে এসে বলে , ভাই এই চিকা কেউ যদি আমাদের সামনেও মুচে দেয় আমরা কিছুই কইতে পারবো না । কারণ আমরা যা করছি তা জেল কোডের লঙ্ঘন । তাই বিচার দিতে পারবো না আর মারামারিও করতে পারবো না । তবে একটা জিনিষ করতে পারবো যতোবার মুচে দিবে অথবা মুচে যাবে আমরা ততোবার লিখে দিবো । আমি কইলাম ঠিকাছে !
আমার জামিনের সময় তাহের ভাই আমার কাপড় চোপড়ের বস্তা লইয়া আমাকে মেইন গেইট পর্যন্ত আগাইয়া দিতে আসছিলো । আর ওয়াদা করেছিলো , সে যতোদিন থাকবে ততোদিন চিকাগুলোর হেফাজত করবে । আর বাইর হইতে পারলে সে এই চিকাগুলো তার ওয়ার্ডের বিভিন্ন স্কুল কলেজ এবং মাদ্রাসার দেওয়ালে লিখে দিবে । তার কাছে আমি ছিলাম এক বিচিত্র কিসিমের লোক ! যে জেলখানায় পকেটের পয়সা খরচ করে বিড়ি আর চা খাওয়াইয়া মানুষকে বই পড়ায় । জেলখানায় টাকার বহুত মূল্য ! টাকা নষ্ট করে কয়জন !
আমার জামিনের দুই দিন আগে তাহেরের বাড়ি থেকে তার জন্যে দুই হাজার টাকা পাঠাইছে । তাই আমি জামিন হইয়া বাইরে আইলেও আবু তাহেরের আর বিড়ি আর চা'র অভাব পড়বে না । দীর্ঘ আড়াইমাস আবু তাহের জেলখানায় মুক্তিযুদ্ধের চেতনা এবং আদর্শ কায়েমে আমার সহযোগী হিসাবে ছিলো ।
আবু তাহেরের জন্য ভালোবাসা

বুধবার, ৬ সেপ্টেম্বর, ২০১৭

৫৭ ধারা একটি কালো আইন । ৫৭ ধারা বাতিল করো ।

৫৭ ধারায় বলা হচ্ছে...
"ইচ্ছাকৃতভাবে ওয়েবসাইটে বা অন্য কোনো ইলেকট্রনিক বিন্যাসে মিথ্যা ও অশ্লীল কিছু প্রকাশ করলে এবং তার কারণে মানহানি, আইনশৃঙ্খলার অবনতি, ব্যক্তির ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন বা ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত লাগলে বা কোনো ব্যক্তি বা সংগঠনের বিরুদ্ধে উসকানি দেওয়া হলে তা অপরাধ বলে গণ্য হবে।"
তার মানে, ইলেকট্রনিক মাধ্যমে মিথ্যা, অশ্লীল বা মানহানিকর তথ্য প্রকাশ সংক্রান্ত অপরাধ এই ধারায় গণ্য হবে।
ধরুন, এক লোক চোর । সে আবার সমাজের ক্ষমতাবানও । কারণ সে এলাকার চেয়ারম্যান । সে মুলত সরকারের চাল চুরি করে খায় । কিন্তু সে যে চোর তা এলাকার বেশির ভাগ মানূষ জানে না । তবে কেউ কেউ জানে । যারা জানে তারা সেই ক্ষমতাবান চোরের ভয়ে সামনা সামনি চুরির প্রতিবাদ করতে পারে না আবার সমাজের অন্য লোকদেরকেও চুরির বিষয়টি জানিয়ে চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে জনমত গঠন করতে পারে না ।
এমতাবস্থায় যদি কেউ একজন অনলাইনে একটি ফেইক আইডি খুলে অথবা রিয়েল আইডি দিয়ে সঠিক তথ্য উপাত্য হাজির করে সেই ক্ষমতাধর চোরের বিরুদ্ধে লেখালেখি করে তাহলেও এই ৫৭ ধারায় তা অপরাধ হিসাবে বিবেচিত হইবে ।
ক্ষমতাধর চোর লোকটি থানায় গিয়া যদি বলে , অমুক আইডি থেকে অমুক লোকটি আমার বিরুদ্ধে মিথ্যাচার করে আমার সামাজিক , সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক এবং ব্যাক্তিগত মানহানি করেছে । তাহলে থানা ফেইক আইডি অথবা রিয়েল আইডির মালিককে ৫৭ ধারায় গ্রেফতার করতে পারে । অপরাধ প্রমাণিত হওয়া না হওয়া পরের ব্যাপার । কিন্তু ক্ষমতাধর চোর চেয়ারম্যানের মান বাঁচাইতে থানা আইডির মালিককে এই কালো আইনে গ্রেফতার করতে পারবে । এই আইনে সেই ক্ষমতা দেওয়া হইছে । চোর চোরই থাকবে মাঝখান থেকে একজন চুরির প্রতিবাদকারী নিরীহ নাগরিক হয়রানির শিকার হবে ।
তারপর এই আইনে বলা হচ্ছে অশ্লীল কিছু প্রকাশ করলে...
আইচ্ছা কোনটা শ্লীল কোনটা অশ্লীল তার সীমারেখা কে ঠিক করে দিবে ? কারো কাছে শব্দ করে ভাত খাওয়াটা শ্লীল আবার কারো কাছে শব্দ করে ভাত খাওয়াটা অশ্লীল । কারো কাছে ভাত খাওয়ার পর সেই প্লেইটে পানি দিয়ে ধুয়ে সেই পানি খাওয়াটা শ্লীল আবার কারো কাছে তা বেশ গা গিনগিনে ব্যাপার । আবার কোন কোন পরিবারে মেয়েদের ছোট ছোট জামা কাপড় পরা বেশ ফ্যাশন্যাবল এবং বেশ অভিজাত্যের প্রতীক আবার কারো কারো কাছে তা বেশ অশ্লীল । কারো কারো কাছে বড় করে পাদ দেওয়া অশ্লীল কিছুই নয় আবার কারো কারো কাছে তা বেশ অশ্লীল ।
এখন যদি কোন ব্যাক্তি যে শব্দ করে ভাত খায় , যে ভাত খাওয়ার প্লেইট ধুয়ে পানি খায় , যে পরিবারের মেয়েরা ছোট জামা কাপড় পড়ে , যে ব্যাক্তি বড় করে পাদ দেয় তাদের বিরুদ্ধে লেখে কোন ফেইক আইডি বা রিয়েল আইডি থেকে এবং ওই সকল ব্যাক্তি যদি থানায় গিয়ে অভিযোগ করে তাহলেও ৫৭ ধারায় আইডির মালিককে গ্রেফতার করা যাইবে । কারণ এই আইনে সেই সুযোগ দেওয়া হয়েছে ।

আবার এই আইনে যারা গ্রেফতার হয় তাদের বিচার করাও কিন্তু বেশ কঠিন । কারণ তথ্য প্রমান সব গায়েব হয়ে যাওয়ার যথেষ্ট সুযোগ আছে । যেমন ধরুন কোন সুনির্দিষ্ট অভিযোগকৃত কোন আইডির বিরুদ্ধে অভিযান চালিয়ে আইডির মালিককে গ্রেফতার করা হইলো । আইডিতে যেসব লেখা আছে তা প্রিন্ট করে এজহার দাখিল করা হইলো আদালতে । বিচার চলার সময় দেখা গেলো যে আইডির বিরুদ্ধে অভিযোগ করা হয়েছে সেই আইডিটি অনলাইন দুনিয়ায় নাই । আইডিটি ডিয়েক্টিভ । অথবা আইডি আছে কোন লেখা নাই । অথবা আইডির নাম ছিলো একটি এখন আইডির নাম হয়ে গেলো আরেকটি । এই অবস্থায় বিচারক কি সাজাদিবেন । অভিযুক্ত আইডির যে লেখাগুলোর বিরুদ্ধে অভিযোগ করা হইছে সেই লেখা সেই আইডি যদি কোন কিছুই অনলাইনে না থাকে তাহলে অভিযুক্ত ব্যাক্তি জামিনে অথবা বেকুসুর খালাসে বের হয়ে আসবে এটাই স্বাভাবিক । কিন্তু হয়রানির স্বীকার হয় এটা সত্য ।

আমরাতো জানিই , ফেইসবুক কতৃপক্ষ ডিয়েক্টিভ আইডির তথ্য কাউকে দেয় না এমনকি সরকারকেও না । ফেইসবুক ইউজারের সাথে গোপনীয়তা রক্ষায় ওয়াদাবদ্ধ । যদি কোন ইউজার তার আইডি ডিয়েক্টিভ করে দেয় অথবা কোন লেখা ডিলিট করে দেয় অথবা আইডির নাম পরিবর্তন করে দেয় তাহলে তা ফেইসবুক কতৃপক্ষ কখনোই কাউকে দেয় না ।
৫৭ ধারা আইন অনলাইন এক্টিভিষ্টদের হয়রানি ছাড়া অন্য কিছু করতে পারে না । এই আইনের মাধ্যমে অপরাধীদের অপরাধ গোপন রাখার বৈধতা দিয়েছে । অপরদিকে নিশ্চিত করেছে অনলাইন এক্টিভিষ্টদের হয়রানি ।

৫৭ ধারা একটি কালো আইন ।
৫৭ ধারা বাতিল করো ।

৫৭ ধারা আর আমি ।

৫৭ ধারায় আমি গত ১৪ জুন ২০১৭ থেকে গ্রেফতার হয়ে ৩১ আগস্ট ২০১৭ পর্যন্ত দীর্ঘ ( আড়াই মাস) কারাবন্দি ছিলাম । বর্তমানে হাইকোর্ট থেকে জামিনে আছি ।
আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিলো , একজন রাজাকার যুদ্ধাপরাধী আর একাত্তরের রাজাকার যুদ্ধাপরাধীর মেয়ে ও ছাত্রীসংস্থার সাবেক এক্টিভ কর্মী এবং ঘাতক দালাল জামাত থেকে আসা আওয়ামীলীগ এমপির বিরুদ্ধে লেখালেখি করেছি । Nagor Ali এবং Gipsy Rudro আইডি দিয়ে ।
অথচ অনলাইনে সার্চ দিয়ে দেখলে দেখা যায় , Nagor Ali নামে যে কয়টি আইডি আছে সেই সব আইডিতে এমন কোন ধরনের লেখা নাই । যে লেখা গুলো অভিযোগ হিসাবে আনছে আমার বিরুদ্ধে । আর সবচাইতে বড় কথা Nagor Ali নামের আমার কোন আইডি নাই । আমার একটাই আইডি ফেইসবুকে Gipsy Rudro । যেটি আমি নিজেই চালাই । এই আইডি থেকে আমি অভিযোগ দাতাদের নামে কিচ্ছু লিখি নাই ।
যে লেখাগুলো আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ হিসাবে দাঁড় করানো হইছে সেই সব লেখা আমি লিখি নাই । অন্যজনের লেখার সাথে আমার নাম এডিট করে বসানো হইছে ফটোশপের মাধ্যমে । নইলে আমার একমাত্র ফেইসবুক আইডি Gipsy Rudro'র টাইমলাইন চেক করে দেখা হোক সেই সব লেখা আছে কি না !
সম্পূর্ণ সন্দেহের উপর ভিত্তি করে আমাকে গ্রেফতার করে সাতকানিয়া থানা আমার বাসা থেকে । পরে থানায় নিয়ে গিয়ে আমার বিরুদ্ধে ৫৭ ধারায় মিথ্যা মামলা দেওয়া হয় । মামলার আগেই আমাকে গ্রেফতার করা হয় । গ্রেফতার করে ১৪ জুন আনুমানিক দুপুর ২ টায় আর মামলা দেয় ১৫ই জুন রাতে ।
আমি জানি না , মামলা হওয়ার আগে কাউকে গ্রেফতার করা যায় কি না ! তবে আমাকে মামলার আগেই গ্রেফতার করা হয়েছে ! আগে গ্রেফতার পরে মামলা !
ক্ষমতাধররা যদি আইনকে যেভাবে ইচ্ছা সেইভাবে ব্যবহার করে তাইলে নাগরিক তো নির্যাতিত হবেই । আমিই তার প্রকৃত উদাহারন ।
আমি ব্যক্তিগত ভাবে মুক্তিযুদ্ধের ধর্মনিরপেক্ষ অসাম্প্রদায়িক চেতনা মনে প্রাণে বিশ্বাস করি এবং বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ধারন করি । আমি বিশ্বাস করি একাত্তরের ঘাতক দালাল রাজাকার যুদ্ধাপরাধী এবং তাদের দোসররা এই দেশের শত্রু । তাদের হাতে ক্ষমতা গেলে এই বাঙলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত ধর্মনিরপেক্ষ অসাম্প্রদায়িক চেতনা মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্থ হইবে ।
তাই আমি ধর্মনিরপেক্ষ অসাম্প্রদায়িক চেতনার পক্ষে আর ঘাতক দালাল একাত্তরের পরাজিত শক্তি জামাতিদের বিরুদ্ধে জনমত গঠন করি । যেখানে যেভাবে পারি ।
ধর্মান্ধ আর উগ্রবাদীদের নাম দিলাম , মৌলবাদ
পাল্টা জবাব দিলো আমাদের, তোরা নাস্তিক মুরতাদ ।
দেশে এখন অবস্থা এমন হয়েছে , ধর্মনিরপেক্ষ অসাম্প্রদায়িক চেতনা এবং বাঙালি জাতির পিতার আদর্শ কায়েমে কোন কথা বললে , ধর্মান্ধ আর উগ্রবাদীদের বিরুদ্ধে কোন কিছু লিখলে তাকে নাস্তিক বলা হয় ।
অথচ চিন্তা করে দেখলে দেখা যায় , মুক্তিযুদ্ধের ধর্মনিরপেক্ষ অসাম্প্রদায়িক চেতনা এবং জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আদর্শের প্রধান শত্রু ধর্মান্ধ আর ধর্মীয় উগ্রবাদীরা !
আমার মনে হয়, আমি জাতির পিতার রক্ত । তাই বাঙলাদেশের এতোটাই ভক্ত ।
তাই হয়ত আমার শত্রু বেশি !
আপসোস !
৫৭ ধারা বাতিল চাই । কোন ক্ষমতাধর ব্যাক্তি চাইলেই এই আইনে দেশের যেকোন অনলাইন এক্টিভিস্টকে ফাঁসাইতে পারবে । এই আইন যথেষ্ট অপব্যবহারের সুযোগ আছে ।