বহু ধরনের প্রেমের অভিজ্ঞতা আমার হয়েছে ।
একটা প্রেম আমাকে এখনো অনেক ভাবায় । তখন আমি স্টুডেন্ট । আমার অনিয়ন্ত্রিত জীবন যাপনের জন্যে পরিবারের
সাথে আমার মনস্তাত্ত্বিক বেশ দূরত্ব তৈরি হয় । আমি চাই আমার মতো জীবন যাপন করতে
তারা চায় আমার চিন্তাকে নিয়ন্ত্রন করতে । বিশ্বাস অবিশ্বাসের সংঘাত তৈরি হয় ।
(এটিকে কবি রুদ্র মুহাম্মদ শহিদুল্লাহ দেখেছেন , এক জেনারেশনের সাথে আরেক
জেনারেশনের চিন্তাগত দূরত্ব হিসাবে । যেমনটি আমার বাবার সাথে তার বাবার চিন্তাগত
দূরত্ব ছিলো !) টাকা দেওয়া বন্ধ করে দেয় পরিবার । ভীষণ অনিশ্চয়তার মুখে পড়ে যায়
আমার জীবন যাপন ।
ঠিক তখনই আমার এই প্রেমটি আমাকে শহরে থাকার
মতো প্রতিমাসে অর্থের যোগান দিতে থাকে । আমি নির্ভর হয়ে পড়ি এই প্রেমের উপর । আমার
মনে হতে থাকে এই প্রেম ছাড়া আমার বেঁচে থাকা অর্থহীন ।
প্রেমিকা শিক্ষিকা ছিলো । শিখিয়েছে অনেক কিছুই
। বয়সে বেশ খানিকটা বড় ছিলো বলেই নিয়ন্ত্রন করতে পারতো আমায়। প্রেমিকার হাতে
নিয়ন্ত্রিত হতে আমার বেশ ভালোই লাগতো । আমি নিয়ন্ত্রিত হতে চাইতাম প্রেমিকার
ইচ্ছায় । আমাকে আমার প্রেমিকা নিয়ন্ত্রন করে – আহ ! কি এক ব্যাথা সুখের মতো বাজে !
এই প্রেমিকা আমাকে প্রেম শিখিয়েছে । দুপুরে
ভাত খেতে গেছি নীলক্ষেতে , প্রেমিকা ভ্যানিটি ব্যাগ থেকে বের করলো , একটা ছোট বাটি
, খুলে দেখি ইলিশ মাছের ডিম ! ফোনে বলেছিলাম ইলিশ মাছের ডিম খেতে ভীষণ পছন্দ করি ।
তাই প্রেমিকা নিয়ে এসেছে ! আমি কোন কথা খাবার টেবিলে সেদিন বলতে পারি নি । নিশ্চুপ
খেয়ে গেছি ! ঠুকঠাক এ কথা সেকথা সে বলেছে , আমি শুধু হ্যাঁ হু করেছি ! আমি
ভাবছিলাম, এই মেয়েটি আমার মতো অনার্সের স্টুডেন্ট পড়ায় ! আর সে কিনা আমার প্রেমে
পড়েছে ! আমি সেইদিনই বুঝতে পেরেছিলাম, চিন্তায় কাছাকাছি হলে বয়স কোন সমস্যাই না !
আমরা বেশ পড়তে পারি একজন আরেকজনকে ।
বিকালে ক্লান্ত হয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে
প্রেমিকা’কে বললাম, খুব ক্ষিধা পেয়েছে , প্রেমিকা হাত ধরে টেনে নিয়ে গেলো সিঁড়িতে
। খুব যত্নে পরিস্কার করলো সিঁড়ি । দুজন ঘন হয়ে বসলাম । প্রেমিকা ভ্যানিটি ব্যাগ
থেকে ছোট একটি বাটি করে আমার হাতে দিলো, আমি খুলে দেখি , পায়েস ! সাথে একটা চোট
চামচ !
আমি প্রথম আবেগি হয়েছিলাম সেইদিন ! আমি
প্রেমিকার দিকে তাকিয়ে আছি ! প্রেমিকা পানির বোতল বের করতে করেত বলে, দেখো পায়েসটা
ঠিক আছে কি না ! অনেকদিন পায়েসের গল্প শুনিয়েছি তোমায় ,এবার খাও ! অনেক যত্নে
বানিয়েছি ! আমার হৃদপিণ্ড সেদিন ভীষণ কেঁপেছিলো ! আমি তেমন কোন কথা বলতে পারি নি !
চুপচাপ পায়েশ খেয়েছি ! আর প্রেমিকার দিকে নিশ্চুপ চেয়ে থেকেছি !
শিল্পি সঞ্চয়ের আঁকা এই প্রেমিকার একটি
পোর্টট্রেট আমার বেডরুমে আছে । একটা সময় ছিলো আমি নিয়মিত এই পোর্টট্রেটের সাথে কথা
বলতাম ! মনে হতো এইতো ঠোঁট নড়ছে ! আমার পাগলামি দেখে মুচকি মুচকি হাসছে ! আমি বেশ আবেগতাড়িত
হয়ে নিয়মিত চুমু খেতাম ! এই প্রেমটি হারানোর পর আমি প্রথমবার বুঝতে পেরেছিলাম ,
প্রিয়জন হারানোর দহন কেমন ! কেমন একটা হৃদয় পোড়া গন্ধ নাকে লাগতো সব সময় !
প্রেমিকা হারানোর পর অনেকবার চেয়েছি পোর্টট্রেট’টি
পানিতে ভাসিয়ে দিই ! কর্ণফুলী নদিতে ! প্রেমিকার সলিল সমাধি রচনা হবে ! পরক্ষনেই
মনে হয়েছে , না ! আমি এমন অমানবিক প্রেমিক হতে পারবো না ! আমি মানবিক । আমার
মানবতা আছে । প্রেমিকা হারানোর ক্ষোভে আমি তার পোর্টট্রেট নদীতে ভাসিয়ে দিতে পারি
না ! আবার মনে হয়েছে, তাহলে বরং মেয়েটির ঠিকানায় পাঠিয়ে দিই ! পরক্ষনেই মনে হয়েছে,
যেই প্রেম আমাকে ঠিকে থাকার জন্যে অর্থের যোগান
দিয়েছে , আমার প্রিয় ইলিশ মাছের ডিম বাসা থেকে রান্না করে নিয়ে এসে দুপুরে খাইয়েছে,
আমার অতি প্রিয় পায়েশ নিজ হাতে বানিয়ে এনে আমাকে খেতে দিয়েছে সেই প্রেমিকার পোর্টট্রেট
আমি নিজের কাছে সারাজীবন না রেখে পাঠিয়ে দিবো ! এটা বেশ অসম্মানিয় ! আমি প্রেমিকা’কে
অসম্মান করতে পারবো না ! এমন সাহস দিয়ে আমাকে পাঠানো হয়নি !
আমি সিদ্ধান্ত নিলাম । তার প্রতি আমার প্রেম
মরে যাক ! শিল্প বেঁচে থাক । এখন এই পোর্টট্রেট’টি আমার কাছে স্রেফ একটা শিল্পকর্ম
। আমি এখন এই পোর্টট্রেট’টির সামনে দাঁড়ায় না ! মিছে মিছে বানিয়ে গল্প বলি না ! ঠোঁটের
উপর আলতো করে চুমুও খাই না ! পোর্টট্রেট’টিও আগের মতো ঠোঁট নাড়িয়ে মুচকি মুচকি হাসে
না ! আমার হারানো প্রেমিকার এই পোর্টট্রেট’টি এখন আমার বেডরুমে হারানো প্রেমের একটা
শিল্পকর্ম ছাড়া অন্য কিছুই নয় ।
আমার বিশুদ্ধ প্রেমিকা’কে সেইদিন বলেছিলাম ,
বাবুনি ! ভাবছি পোর্টট্রে’টি এখান থেকে সরি ফেলবো ! সে মুচকি হেসে বলল, থাকুক না
এখানে ! আমার কাছে এটা স্রেফ একটা শিল্পকর্ম ! এটি আমার দেখতে ভালোই লাগে !
বিশুদ্ধ প্রেমিকার কথা শুনে আমি সেদিন
ভেবেছিলাম, আমি শালার হেব্বি হ্যাপি আছি ! হারানো প্রেমিকার প্রেমময় শিল্প আর
বিশুদ্ধ প্রেমিকার প্রেম নিয়ে...